আমার শিক্ষক জীবন | NARODNIK


আমার শিক্ষক - জীবন
মিনা ভাওয়াল (ভৌমিক)

আমি একজন অতি সাধারণ শিক্ষক। আমি যখন ক্লাসে পড়তাম তখন আমার ছাত্রীদের দিকেও প্রখর দৃষ্টি থাকত। কিন্তু আমি তাতে ব্যর্থ হয়েছি। এখন ফেসবুকে দেখতে পাচ্ছি যে ভাল ছাত্রীরাও নাকি কখনও কখনও ক্লাসে দুষ্টুমি করত - যা আমার নজর এড়িয়ে।

যাক কলেজ পাস করেই আমার চাকরি জীবন শুরু হয়। এই স্কুল যেদিন প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়, সেদিন আমিই প্রথম টিচার, আমিই ক্লার্ক। প্রথম দিনই আমি বাইশ কি সাতাশ জন ছাত্রীকে ভর্তি করি। আসল সংখ্যাটা আজ আর মনে নেই। তখন ইলাদেবী স্কুল ছিল কমপ্লিট বেসিক অর্থাৎ এইট পর্যন্ত। এই স্কুলের সব যোগ্য দিদিমণিরা আমাদের হাই স্কুলে যোগদান করেন। তখন স্কুলে কোনও প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন না। কমিটি অলকাদিকে মনোনীত করেছে -কিন্তু তিনি তখন কোচবিহারে নিউটাউন গার্লস স্কুলে চাকরি করতেন। ঊনত্রিশে জানুয়ারী ১৯৬৪ সালে স্কুল শুরু হল আর অলকাদি জয়েন করেন দিন পনেরো পর। এ কদিন আমিই স্কুল চালিয়েছি তবে সব দিদিমণিই প্রথমে আর্থিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হন। আমরা তখন মাসে একশ টাকা করে পেতাম। দশ টাকায় আমাদের টিফিন খাওয়া হয়ে যেত। তখনও বরুণের দোকান হয়নি। নন্দেশ্বরি বলে একজন বয়স্ক মহিলা ছিল - আমাদের জল আনা, টিফিন আনা, চা আনা এ সমস্ত কাজ করত। আমরা বাজার থেকে খুরমা এনে ভাগ করে খেতাম। দুই টাকার অনলেই সবার হয়ে যেত। আমরা তখন সাত-আট জন ছিলাম। ইলাদেবী স্কুলটা জুনিয়র বেসিক অর্থাৎ ফাইভ পর্যন্ত হয়ে গেল। জুনিয়র বেসিকের দিদিমণি ও আমরা একসাথে স্টাফরুম শেয়ার করেছি। পুরনো বিল্ডিং-এ ঢুকেই বাঁদিকে স্টাফরুম, মাঝে প্রধান শিক্ষিকার ঘর, পরে ছিল নারায়ন বাবুর (ক্লার্ক) ঘর এবং একদম শেষে প্রথমে নাইন ও পরে টেনের ক্লাস হত। সবই ওই পুরনো বিল্ডিং-এ। অন্য ক্লাস এর পুবদিকের ঘরটায় হত।

তখন আমাদের ক্লাস এইটের ভাল ভাল ছাত্রীরা হাইস্কুলে নাইনে ভর্তি হত। মাঝারি ও লেখার স্ট্যান্ডার্ড-এর ছাত্রীদেরই আমরা পেতাম - যা উমাদির ভাষায় ছিল তলানি ও ফেলানি। হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ধীরেন্দ্র নাথ বসু ইংরেজি পড়াতেন, গোপেন বাবু পড়াতেন ইকোনমিক্স আর স্কুলের পাশের পন্ডিতমশাই সংস্কৃত পড়াতেন এভাবেই স্কুল চলছিল। কিন্তু আমরা হারিনি। আমাদের প্রথম ব্যাচের মাধ্যমিকে দুজন পাস করেছিল - একজন সুমিতা ব্যানার্জি আর অন্যজন সন্ধ্যা দত্ত। এরাই আমাদের স্কুল আকাশের প্রধান নক্ষত্র - এদের জন্যই আমাদের ইস্কুলের মুখ উজ্জ্বল হয়েছে। এর কয়েক বছর পর সুচরিতা সাহা প্রথম অংকে লেটার মার্কস পায়। এরপর লুপর্ণা সেনগুপ্ত প্রথম ভূগোলে লেটার মার্কস পায়। অলকাদির ঘরে রেজাল্ট দেখে আমি সেদিন আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিলাম। আর দীপ্তিও ছিল আমার পাশে। 

একে একে উমাদি, অঞ্জলিদি, করুণা, দীপ্তি, মিনতী, শিবানীরা জয়েন করে। হাইস্কুলও নাইনে মেয়েদের নেওয়া বন্ধ করে দেয় আর আমরাও মাধ্যমিকে ভাল ফল পেতে শুরু করলাম। উমদি আসার আগে পর্যন্ত আমিই নাইন ও টেনে বাংলা ও ভূগোল পড়াতাম। আমরা এক একদিনে সাত-আটটা করে ক্লাস নিয়েছি। কিভাবে করতাম জানেন? আমি কোনও একটা ক্লাসে ক্লাস নিচ্ছি, পাশে হয়তও উমাদি বা অন্য কারোর ক্লাস ছিল - যিনি সেদিন অনুপস্থিত। পাশের ক্লাসের মেয়েরা হয়তও গন্ডগোল করছে তাই আমরা ক্লাসে পড়া দিয়ে উমাদির ক্লাসে হয় লিখতে দিতাম বা পড়া ধরতাম। আমি গ্রীস্মের ছুটিতেও ক্লাস নিতাম। আমাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল আমরা পেতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে।

বাংলা ও ভূগোল দুটো বিষয়ই আমার এত প্রিয় যে আমার পরের দিনের ক্লাসের জন্য কোন প্রস্তুতির প্রয়োজন হত না। ভূগোলে তো বিভিন্ন দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বাদে আর পুরো ভূগোল সাবজেক্টই আমার চোখের সামনে ভাসত। এছাড়াও উমাদির অপছন্দের কিছু ক্লাস যেমন ক্লাস ফাইভে নকলগড় কবিতা রামায়ণের সুরে মুখস্থ বলা অথবা ঐ ক্লাসেই বিজ্ঞানে কলেরা রোগীর চাল ধোয়া জলের মত দাস্ত - এগুলো আমিই নিতাম। বড়দিদির মত উমাদির শাসনও আমরা সবাই মেনে নিতাম। আমি একদিন বা‍ঁ দিকে সিঁথি করে চুল আঁচড়েছিলাম বলে উমাদি হালকা শাসন করেছিলেন। কিন্তু আমি কিচ্ছু মনে করিনি। উনি তো বড়, উনিই তো আমাদের সঠিক পথ দেখাবেন। কোনও টিচারের কোনও রকম অসুবিধার দিকে আমার সবসময় নজর থাকত। নিজে রুটিন করতাম বলে প্রায় সবার ক্লাসই মুখস্থ থাকত আমার। আমি তো দোতালার একদম উত্তর দিকের ঘরে ক্লাস থাকলে মেয়েদের থেকে একটু জল চেয়ে নিয়ে খেয়ে অন্য ক্লাসে যেতাম। তাতে যাতায়াতের সময়টা বেঁচে যেত। বারবার কমনরুমে আসা মানেই সময়ের অপচয়। আমি ছুটিও খুব কম নিতাম - তাতে সিলেবাস শেষ করতে সুবিধা হত।

আস্তে আস্তে স্কুল বড় হতে থাকল - ছাত্রীর সংখ্যাও বাড়তে থাকল। আমি কিন্তু বেশিরভাগ ছাত্রিরর নাম ধাম মুখস্ত রাখতে পারতাম। আমাদের ছাত্রীরা সবাই ভাল। তবে তার মধ্যেও মান্টি বসাক বোর্ডে কুড়ি জনের মধ্যে স্থান করে নিল। এরপর অনন্যা ডিস্ট্রিক্ট ফাস্ট হল। প্রতিবছরই সাত-আট জন করে ভূগোলে লেটার মার্কস পেতে থাকাল-আর তা কিন্তু প্রাইভেট টিউশন নিয়ে নয়। প্রতিবছর পনেরোই আগস্ট ও ছাব্বিশে জানুয়ারি তে আমি লাইনে যেতাম - আর এটা আমার খুব ভালো লাগত। এছাড়া রীনা আসার আগে আমিও ঝর্ণাই স্কুলের খেলাধুলার দেখভাল করতাম। ঝর্ণা ও আমি সহপাঠী ছিলাম। এরপর দীপ্তি ও পরে সুলেখা স্কুলে আসে। আমাদের স্টাফরুমে নিজেদের মধ্যে এত ভাল সম্পর্ক ছিল যে কি বলব! আমরা সবাই একে অন্যের সুখে দুঃখে পাশে থাকতাম - একে অন্যের সুখে সুখী ও অপরের দুঃখে দুঃখিত হতাম। এথেনা মজুমদার অল্প কয়েকদিনের জন্য আমাদের স্কুলে কাজ করে গেছে। ও বলত যে এরকম স্টাফরুম ও আগে আর কখনও দেখেনি। ও এর আগে অন্য স্কুলেও কাজ করে এসেছে। আমাদের স্টাফরুম বিশ্বের একমাত্র শ্রেষ্ঠ স্টাফরুম।

স্কুলের রজত জয়ন্তী উৎসবে অনেক বেশি দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছিলাম। আমরা কয়েকজন মিলে সারা তুফানগঞ্জ চষে ফেলেছিলাম। আমরা পায়ে হেঁটে সব প্রাক্তন ছাত্রীদের বাড়ি গিয়েছি - যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী টাকা দিয়েছে, আমরা তাই নিয়েছি। এক ছাত্রী আমাদের এক টাকা বারো আনা দিয়েছিল, আমরা তাইই নিয়েছিলাম। শুধু একদিনই আমি, বীথিকা ও সুনীতা চামটা গিয়েছিলাম বাসে করে - দেড় টাকা খরচ করে। আর কোনদিন একটা পয়সাও আমরা খরচ করিনি। প্রতিদিনের টাকা শুকদেবকে জমা দিয়ে দিতাম - ওই হিসাব রাখত। আমাদের তুফানগঞ্জ সাফাই অভিযান সবার খুব ভাল লেগেছিল। এছাড়া উদ্বোধনী প্রসেশন খুব আনন্দ দিয়েছিল তুফানগঞ্জ বাসিকে। প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রী মিলে বিশাল প্রসেশন। লেজিম নিচে নাচ ও বিভিন্ন রাজ্যের পোশাকে সজ্জিত মেয়েদের খুব সুন্দর লাগছিল। শেষপর্যন্ত প্রোগ্রাম মোটামুটি উৎরে যায়। মেয়েদের ব্যাপার তো তাই তিন দিনের বেশি অনুষ্ঠান করতে পারিনি। ভয় ছিল মেয়েদের নিয়েই -  রাতের অনুষ্ঠান, যদি কোন খারাপ ঘটনা ঘটে যায়। এই ভয়েই আমরা তিন দিনের বেশি অনুষ্ঠান করিনি। প্রাক্তন ছাত্রী - সম্মেলনেও খুব ভালোভাবেই হয়েছিল। তার মধ্যে টুসির (আলোকপর্ণা) বক্তব্য খুব মজার ছিল। ও স্কুলে যা যা দুষ্টুমি করেছিল সব স্বীকার করেছে। একদিন নাকি উমাদির জন্য রাখা রসগোল্লা চুরি করে খেয়ে নিয়েছিল। এভাবেই উৎসব শেষ হয়ে যায়।

 আমার একটা বিশেষ কর্তব্যের কথা না বললে আমার লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমার কাজ ছিল ছাত্রীদের মুখের দিকে না তাকিয়ে একটা থাপ্পর দেব - শর্ত ছিল এটাই। মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষায় যারা অল্পের জন্য পাশ করতে পারেনি বা একটা বিষয়ে ফেল করেছে -  তাদের ভাল করার দায়িত্ব বর্তায় আমার উপরে। যিনি রেজাল্ট দিচ্ছেন তিনি বকুনি দিয়েই খালাস। এবার আমার পালা। কাউকে কান ধরে ওঠ বস করিয়ে কথা আদায় করেছি ফাইন্যালে ভালো করবে। তবে মজার কথা কি এরা কিন্তু সবাই পাস করে গেছে। অনিচ্ছাকৃত থাপ্পরে যদি কেউ পাস করে যায় তার চেয়ে আনন্দের আর কিছু নেই। একবার একটি মেয়ে যার ফেল করার কথা নয় কিন্তু সে টেস্টে ফেল করেছে। মেয়েদের দিয়ে ঐ ছাত্রীকে ডেকে পাঠাই। ওর কাছ থেকে জানতে পারি যে পরীক্ষার সময় ওর বাবা অসুস্থ ছিলেন। তাই ওর পরীক্ষা ভালো হয়নি। আমি নিজে দায়িত্ব নিয়ে ওকে পাস করিয়ে দিলাম। ও কিন্তু আমার সম্মান রেখেছিল। ও সেকেন্ড ডিভিসনে পাস করে যায়। এই যে আনন্দ এর মত আনন্দ জীবনে খুব কম পাওয়া যায়।

 কত ছাত্রীর খাতায় অভিভাবককে লিখে দিয়েছি - একটু নজর দেবেন ওর পড়াশোনার দিকে। অনেকেই সাড়া দিতেন আবার এক আধজন কোনও জবাব দিতেন না। অবশ্য এদের ভবিষ্যৎ ভালো হয়নি। আবার এক ছাত্রির বাবা লিখলেন - দিদিমণি আমি বেশি পড়াশোনা জানি না, ওকে আপনিই দেখবেন। একে কি বলবেন আপনারা? আবার যেসব ছাত্রি, যারা নাইনে উঠে শাড়ি পড়ে (তখন শাড়ি পড়তে হত) নায়িকা হয়ে যায় তাদের তো কথায় জব্দ করতে হয়। একজনকে বলেছিলাম - কিরে চুল খুলে এলে তোমায় দারুণ দেখায় - আসার সময় কেউ বলেছে বুঝি? সেই যে মাথা নীচু করল, আর মাথা তোলেনি। যেদিন অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট দিচ্ছি সেদিন সেই মেয়েটি প্রণাম করে আমাকে বলল - দিদিমণি আপনি সেদিন বলেছিলেন বলেই আজ আমি পাশ করেছি, নইলে করতাম না। একে কি বলবেন? এটা কবেকার কথা কিন্তু আজও মনে দাগ কেটে রয়ে গেছে। এগুলো ভুলবার নয় - ভোলা যায় না।

একদিন বীথিদি বললেন ওনার মেয়েটি বাড়িতে কথা শোনে না আর খুব জ্বালাচ্ছে। মীনা তুমি ওকে একদিন পেটাও -  তোমাকেই পারতে হবে। আমি ভাবছি কি করি কি করি - কিভাবে ওর মত একটা ভাল মেয়েকে পেটাব? এদিকে সব দিদিমণিরা আমাকে চ্যালেঞ্জ দিল যে আমি মৌ-কে মারতে পারব না। আমিও ওদের চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট করে ক্লাসে গেলাম। আমি শুধু ভাবছি কি করব, কিভাবেই বা করব!  ভাবতে ভাবতে ক্লাসে গেলাম। বাংলা পরীক্ষার ফাস্ট পেপারের খাতা দিচ্ছিলাম। ও রিট্রানশ্লেষণে  এক জায়গায় ভুল করেছিল। ওকে জিজ্ঞেস করাতে ও বলল যে ওর কোনো ভুল হয়নি। আর যায় কোথায়! সঙ্গে সঙ্গে ওকে সামনে ডেকে এক থাপ্পর - যদিও আমার খুব খারাপ লাগছিল - তুচ্ছ কারণে একটি মেয়েকে মারলাম। ছি‍ঃ ছিঃ ছিঃ এ আমি কি করলাম! এ দুঃখ আমার আজও আছে।

আর একদিনের কথা বলছি। মাধ্যমিকের সেদিন রেজাল্ট বেরিয়েছে - ভূগোলে সাতজন লেটার মার্কস পেয়েছে। আমি ও রত্না বাড়ি ফিরছিলাম। কাছারির সামনে আসতেই হাইস্কুলের একজন টিচার আমাকে বললেন - দিদিমণি আপনি তো ভূগোলের প্রাইভেট টিউটরদের ভাত কেড়ে নিচ্ছেন। আমি বললাম সেটা কিভাবে? তিনি বললেন -আপনি ক্লাসে মেয়েদের বলেন - তোদের বাবার কি পয়সা বেশি হয়েছে যে ভুগলেও প্রাইভেট পড়তে হবে? আমি কি ক্লাসে পড়াই না? আমি কি ক্লাসে পড়াই না? আমি যেভাবে পড়াই তোরা যদি ঠিকমত ফলো করিস তাহলে আর কোন টিচারের দরকার হয় না। আচ্ছা আপনি যদি এভাবে বলেন তবে আমাদের প্রাইভেট টিউটরদেব কি হবে বলুন তো! আমি হেসে কিছু না বলে চলে আসি। আমিও টিউশন করেছি তবে তা অবসর নেবার পর। নগদা একদিন এসে বললেন, তোমার ছাত্রী তো ভূগোলে ভীতি। আমি বললাম - পাঠিয়ে দেবেন দেখিয়ে দেব। পরীক্ষার হলে ওর নাকি চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল - আমি সবগুলো পরব। এরপর নগদান টাকা দিতে এলে আমি বলেছিলাম যে আমি বিদ্যা বিক্রি করি না। শশধর সরকারেরও একই অবস্থা; আর আমিও একই কথা বলেছিলাম। তখন তো আমার চাকরি ছিল। আমি কোনদিনই বেশি টাকার লোভি ছিলাম না। অভাববোধও ছিল খুব কম।

আমাদের স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কথা না বললেই নয়। তখন স্কুলে কত ভাল ভাল অনুষ্ঠান হত। স্কুলে আমার প্রথম দিকে রবীন্দ্রজয়ন্তী হত সকালে। তারপর ছাত্রীদের অনুরোধেই পরে বিকেলে অনুষ্ঠান করা হত। ১৯৬৫ তে স্কুল যখন বোর্ডের স্বীকৃতি পায় তখন টিচারদের আর্থিক সুবিধা হল আর স্কুলও সরকারের কাছ থেকে টাকা পেতে থাকল। কিন্তু বিল্ডিং তৈরি করার মত আর্থিক ক্ষমতা আমাদের ছিল না। তখন এক সাহেব আমাদের প্রথম বিল্ডিং তৈরি করে দেন।

স্কুলের আর্থিক অবস্থা কিছুটা ভাল হলে আমরা প্রতিবছর বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান করা হত। তাতে মেয়েরা নাচ, গান ও আবৃত্তিতে যোগ দিত। আমি রবীন্দ্রনাথের ছুটি, পুরাতন ভৃত্য, সাগরিকা, অভিসার, পূজারিণী এগুলো মঞ্চস্থ করেছিলাম। যে দুজন ছাত্রী ছুটিতে ফটিক ও পুরাতন ভৃত্য কেপ্টার চরিত্রে অভিনয় করেছিল সেই দু'জন ছাত্রিই মারা যাওয়ায় আমি ও সব থেকে সরে আসি। এরপর আসে মিনতী। ও এসে পুরোদমে নাটক, গীতিনাট্য করানো শুরু করে। আর বীথিদিও সঙ্গে সঙ্গে নাটক করতেন। এরমধ্যে রামের সুমতি, অরুণ বরুণ কিরণমালা খুব ভালো হয়েছিল। রামের সুমতিতে রাম -সুপর্ণা সেনগুপ্ত সেনগুপ্ত ও নারায়ণী অনিতা রক্ষিত দারুন অভিনয় করে। সবাই ওদের প্রশংসা করেছিল। এদিকে কিরনমালার চরিত্রে কে অভিনয় করবে তা ঠিক করা যাচ্ছিল না। হঠাৎই ক্লাস ফাইভে একটি ছোট্ট মেয়ে ভর্তি হতে এল। আমি মেয়েটিকে একবার দেখেই ওকে ধরে বিথীদির কাছে নিয়ে যাই। বীথিদিরও খুব পছন্দ হয় মেয়েটিকে। মেয়েটির চোখ দুটি খুব সুন্দর ছিল! তেমনি সুন্দর অভিনয়ও করেছিল। রুমা নন্দী হয়েছিল সোনার পাখি। ও সোনার পাখির মুখোশ পড়ে নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না - বারবার ভেতরে এসে মুখোশটা খুলে ফেলেছিল। আর দৈত্যের ভূমিকায় তনুশ্রী গাঙ্গুলীর নাচ খুব ভালো হয়েছিল।

ভাল হয়েছিল মিনতীর করানো 'অ্যালফাবেট ক্লাব' , একটি বাচ্চা মেয়ে এ. বি. সি. ডি. পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ে। সে স্বপ্নে ছাব্বিশটা অ্যালফাবেট এসেছে - এসেছেন গ্রামার সাহেব। তিনি ওয়ার্ড তৈরি করা শেখাচ্ছেন আর আছে ভাওয়েলরা। ওদের গানের লাইনগুলো এখনও মনে আছে--
ভাওয়েল, ভাওয়েল, ভাওয়েল, আমরা হলাম ভাওয়েল।
মোদের ছাড়া কনসোনেন্টরা এক্কেবারে ঘায়েল।

আমার মেয়ে হয়েছিল নাটকের ওই ছোট্ট মেয়েটি। আর নন্দিনী বর্মার গ্রামার সাহেব অনবদ্য। এছাড়াও মিনতী অনেক অনুষ্ঠান করেছে। একবার কথা ছাড়া যেতে নাহিদিব, পুরাতন ভৃত্য করিয়েছিল। দীপ্তিও একবার একটি ইংরেজি কবিতার অভিনয় করিয়েছিল। রজতজয়ন্তীতে মিনতীর 'রথের রশি' আর শিবানীর বিভিন্ন রাজ্যের নাচ খুব প্রশংসা পেয়েছিল। এছাড়া বিভিন্ন উপলক্ষে ছোটখাট অনুষ্ঠান প্রায়ই হত। তখন ইস্কুলে আশা ছিল, প্রাণ ছিল, ছিল এগিয়ে যাওয়ার আগ্রহ। রজতজয়ন্তী এক্সিবিশনে শুক্লা বিশ্বাস একটি চার্ট বানিয়ে ছিল তাতে প্রত্যেকের জন্ম তারিখ বলে দিতে পারতে চার্ট দেখে। হাই স্কুলের ছেলেরা - আমার বিয়ের তারিখ টা বলে দাও বলে ওকে খুব বিরক্ত করেছিল - অনেক কষ্টে ওদের বের করা গিয়েছিল। এগুলো তো থাকবেই - এগুলো ঝামেলা না থাকলে অনুষ্ঠান কিসের?

আমার চাকরীর এগারো মাস বাকি থাকতেই আমি স্কুল ছেড়ে দিলাম। সে যে কতখানি দুঃখে আমি ইস্কুল ছেড়েছি তা আমিই শুধু জানি। আমার রাত্রে ঘুম হত না - শুধু ভাবতাম কেন এমন হয়? আমি দেখলাম নিউ জেনারেশনের কাছে আমি বেমানান। আমি গোঁয়ার; আমি স্কুল আর ক্লাস ছাড়া কিচ্ছু বুঝি না। আমি এযুগের উপযোগী নয় -আমি পুরাতন পন্থী, আমি রক্ষণশীল। কয়েক মাস আগেই অবসরের দিন চলে আসে। মনটা খুব খারাপ। অন্যরা ভালো ভালো কথা বললেও আমি কিছু বলতে পারিনি। সন্তানের সাথে মায়ের যে নাড়ির সম্পর্ক - আমার সঙ্গেও স্কুলের সেই একই সম্পর্ক - তাকে ছেড়ে যেতে কষ্ট তো হবেই। আসলে আমি একটি পাগল। স্কুল পাগল বলতে যা বোঝায় - আমি তাই। আমার নামের জন্য আমি কোনদিন কোনও কাজ করিনি। আমি স্কুল ছাড়লাম - হে বন্ধু বিদায়।


 

Post a Comment

0 Comments