শিক্ষায় ফি বৃদ্ধি ও ছাত্র আন্দোলন
সম্প্রতি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্রদের কাছ থেকে ভর্তির সময় ফ্রী সংগ্রহ করছে। এতে সর্বত্রই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। কোথাও কোথাও অভিভাবকগণ তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
মার্চ'২০ থেকে আজ পর্যন্ত ধারাবাহিক লকডাউন চলছে। সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। স্বাভাবিক পঠন-পাঠন সহ সমস্ত পরীক্ষা, বিদ্যালয় নিয়মিত সহপাঠক্রমিক কর্মসূচি সব বন্ধ। এ অবস্থায় পরপর দুটো শিক্ষাবর্ষে ফি আদায় করার কোন বাস্তবসম্মত কারণ নেই। সরস্বতী পূজা হয়নি তবু পুজোর চাঁদা নেওয়া হচ্ছে, কোন ডেভলপমেন্ট মূলক কাজ হয়নি তবুও ছাত্রপতি ২৪০ টাকা সরকার নির্ধারিত ফি উপেক্ষা করে ৫০০/৬০০/৮০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে।
সরকার শিক্ষক, শিক্ষা কর্মীদের পুরো বেতন দিচ্ছে। এছাড়া সংকটের কারণে সমস্ত সরকারি পোষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ৬০০০০,৭০০০০ টাকা করে দিচ্ছে। আগে ছাত্র দের কাছ থেকে বিভিন্ন খাতে যেমন ভর্তি ফি, ডেভলপমেন্ট ফি, ম্যাগাজিন ফি প্রভৃতি বাবদ গ্রামের স্কুল গুলো ৬৩ টাকা, শহরের স্কুলগুলো ৭৫ টাকা নিত। কিন্তু পরে সমস্ত ফি-কে একত্র করে সর্বোচ্চ ২৪০ টাকা ডেভলপমেন্ট ফি নেওয়া যাবে এমনে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। এই সার্কুলার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যালয় পরিচালন কমিটি তৎপর হয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ ফি আদায় করতে শুরু করে।
অথচ, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী সমস্ত ছাত্রছাত্রীকে বিনে পয়সায় ভর্তি করে পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার কথা। সে মর্মে শুধু সার্কুলার নয়, একটা আইনও চালু আছে। এই আইন কিন্তু কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুসরণ করছে না। প্রধান শিক্ষকদের নজরে পড়ছে না। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে ছাত্র-ছাত্রীদের বিনে পয়সায় ভর্তি করলে স্কুল চলবে কি করে। রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব সরকারকে নিতে বলা হয়েছে। কেন সে দায়িত্ব সরকার পালন করছে না, সমস্ত বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে সরকারের কাছে দাবি আদায় করতে পারত। সে পথে না গিয়ে 'খরচ কিভাবে চালানো হবে' এই প্রশ্ন তুলে ব্যাপকহারে টাকা আদায় করার যে প্রচেষ্টা এটা একটা শিক্ষাক্ষেত্রে অশনি সংকেত।
গরীব, মেধাবী ছাত্ররা পড়তে না পারলে তাদের পড়ার ব্যবস্থা করার জন্য হাপ-ফ্রি ও ফুল-ফ্রি'র ব্যবস্থা করে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাঙ্গনে নিয়ে আসা, শিক্ষাকে সবার কাছে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করত। আজে এসব উঠে গেছে। উঠে গেছে বললে ভুল হবে, শিক্ষা পরিচালকদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেছে। তাই সেগুলো আর বেশিরভাগ স্কুলে চালু নেই। হত দরিদ্র হউক, আর আর্থিক সঙ্গতি না থাকুক - 'ফেল করি মাখো তেল' এই নীতিতে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদেরই আয়ের উৎস করা হচ্ছে।
স্কুলের নাইট গার্ড সরকার দেয়নি, অনেক বিষয়ে শিক্ষক নেই, বিদ্যালয় যে কর্মচারীরা আছে তা দিয়ে সমস্ত কাজ হয়না, তার জন্য আরও লোক দরকার, বিদ্যালয়ের অডিটি হিসাব মিলাতে চাই অতিরিক্ত টাকা। উপরোক্ত সব সমস্যা মেটাতে চাই টাকা। আর সব যোগাবে ছাত্রছাত্রীরা অর্থাৎ সাধারণ অভিভাবকেরা।
একটা গণতান্ত্রিক দেশে এটা সরকারের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে সরকারকেই বাধ্য করা উচিত। এ না করে সরকার দিচ্ছে না আমরা কি করব এ মনোভাব অত্যন্ত নিন্দনীয়। এক সময় শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্রদের কাছ থেকে বেতন আদায় করা হত। সেই বেতনের টাকা যা উঠত শিক্ষক মহাশয়েরা ভাগ করে নিতেন। পুরো বেতন পর্যন্ত নিতে পারতেন না। তবুও মেধাবী ছাত্রদের বিনে পয়সায় পড়ার ব্যবস্থা করতেন, দরিদ্রদের বেতন মুকুব করতেন। পড়াশোনায় উৎসাহিত করতেন। এমনও দেখা গেছে স্বল্প বেতন পেলেও ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে তাঁরা থাকতেন। তাই তাঁরা শিক্ষকদের স্থানকে সমাজের উচ্চ আসনে দাঁড় করেছেন। সেই শিক্ষকগণ বারেবারে সরকারের কাছে দাবি করেছেন। ঐতিহাসিক শিক্ষা আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। শিক্ষক মহাশয়গণ আন্দোলনে রক্ত ঝরিয়েছেন। তাই আজকের প্রজন্মের শিক্ষকরা শিক্ষকতায় নিযুক্ত হয়েও পুরো বেতন পাচ্ছেন, ছাত্রদের বেতন থেকে তাদের বেতন নিতে হচ্ছে না। তবুও আজকের শিক্ষকগণের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি আচরণ অত্যন্ত বেদনায় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ছাত্র-ছাত্রীরা ফি প্রত্যাহারের দাবি করলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা বিব্রতবোধ করেন। কিছু শিক্ষক পাশে থেকে যুক্তি করেন। ছাত্রদের বিরুদ্ধে স্থানীয় নেতাদের লেলিয়ে দেন, অনেক ক্ষেত্রে দুর্ব্যবহার করেন। এ তো এক গভীর সংকট।
অথচ শিক্ষাকে অবৈতনিক করা উচিত। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা যেভাবে ব্যয় হয়, তার সামান্য কিছু অংশ ব্যয় করলে ছাত্র-ছাত্রীরা বিনে পয়সায় পড়তে পারত। আগামী প্রজন্ম বিশেষ করে সাধারণ ঘরের সন্তানরা মানুষ হবার সুযোগ পেত। তাই ছাত্র-ছাত্রীদের এ দাবি সভ্যতা বিকাশেই সাহায্য করবে।
0 Comments