স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু - কিছু প্রশ্ন | NARODNIK

স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু 
 কিছু প্রশ্ন 




৫ই জুলাই' ২১ মুম্বাই-এর একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যু হল ৮৪ বছর বয়স্ক সমাজকর্মী স্ট্যান স্বামীর। আদালতের নির্দেশে জেল হেফাজতে রেখেই পায়ে পুলিশের বেরি লাগানো অবস্থায় তাঁর চিকিৎসা চলছিল। তিনি ছিলেন একজন খ্রিষ্টান ধর্মযাজক। পারর্কিনসন্স সহ বার্ধক্যজনিত নানা অসুখে ভুগছিলেন এই প্রবীণ ব্যক্তি।

ভীমা কোরেগাঁও মামলা সূত্র ধরে ২০২০ সালের ৮ই অক্টোবর জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এন আই এ) তাঁকে রাঁচি থেকে ইউ এ পি এ-আইনে গ্রেফতার করে। গ্ৰেফতারের সময় তাঁর বিশেষ প্রয়োজনীয় সঙ্গী চশমাটি কে নিতে দেন নি। অথচ চশমা ছাড়া কার্যত তিনি অন্ধ। বার্ধক্যজনিত কারণে তার শরীর ছিল আসক্ত। তিনি তরল খাবার ছাড়া কিছুই খেতে পারতেন না। খাবার চটকে দিলে স্ট্র ও সিপার ব্যবহার করে তবে সেই খাবার খেতে পারতেন। গ্রেফতারকারী আধিকারিকরা তো বটেই, এমনকি তদন্তকারী আধিকারিকরা তাঁর খাদ্য গ্রহণের পক্ষে অত্যাবশ্যক স্ট্র ও সিপাব নিতে দেন নি। ফলে তাঁর পক্ষে খাদ্য গ্রহণ করাও অসম্ভব ছিল।

বারবার আদালতে আবেদন করার পর যখন স্ট্র ও সিপার ব্যবহারের অনুমতি মিলল ততদিনে তিনি না খেতে খেতে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই পরিকল্পিতভাবে তাঁকে একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আদালতে বারবার তাঁর জামিনের আবেদন করা হয়। কিন্তু জামিন মেলে নি, সমস্ত আবেদনই খারিজ হয়েছে। খবরে প্রকাশ, খাওয়া ও চলার প্রশ্নে জেলের অভ্যন্তরে তাঁর সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে তা অত্যন্ত অমানবিক। চিকিৎসা জরুরী হলেও তাঁকে সময়মতো চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হয় নি। শেষ পর্যন্ত যখন তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে এলেন তখন আদালতের নির্দেশে এল চিকিৎসা করানোর। হাসপাতালে ভর্তি করা হল। অবস্থা আরো সংকটজনক হলে মুম্বাই-এর আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। অতঃপর সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

এই মৃত্যু রেখে গেল কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এর ফলে ভারতীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি সন্দিহান হয়ে পড়লেন সমস্ত স্তরের মানুষ। সমস্ত বিষয়ে তাঁরা স্তম্বিত হয়েছেন। তাই অনেকে বলেছেন, এটা 'প্রতিষ্ঠানিক হত্যা', হত্যা করার 'ষড়যন্ত্র'।

অধিকার রক্ষার লড়াই-এ পৃথিবীর সর্বত্র সব সরকারের আমলে কেউ না কেউ এগিয়ে আসে। স্ট্যান স্বামী এমন একজন ব্যক্তি যিনি দীন থেকে দীনতর মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়-এ এগিয়ে এসেছেন। সত্তর দশকের মাঝামাঝি বেঙ্গালুরুতে কৃষিক্ষেত্রে বেগার মজুরদের স্বাধীনতা ও অধিকারের জন্য, ১৯৭৮ সালে ভিল্লমপুরম ও তাঞ্জোরে দলিতদের জন্য এবং জীবনের অনেক বেশি সময় ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের কল্যাণে কাজ করেছিলেন। তিনি ভারতীয় সংবিধানের পঞ্চম তফশীল অনুযায়ী আদিবাসী এলাকায় 'ট্রাইব অ্যাডভাইজারি কমিটি' গরার দাবি করেছিলেন। আদিবাসীদের ন্যায় বিচারের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন, প্রয়োজনে জনস্বার্থ মামলাও করতেন। খনিজ পদার্থের জন্য বা শিল্প গড়তে আদিবাসীদের জল, জঙ্গল, জমির অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন অত্যন্ত সবর। তাঁর কণ্ঠে ছিল নির্ভীক। এমন মানুষই আজ ভারত সরকারের পক্ষে বিপজ্জনক ও চক্ষুশূল।

স্ট্যান স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ২০১৮ সালের ১লা জানুয়ারী ভীমা কোরেগাঁও-এ দলিতদের একটা সমাবেশ হয়েছিল। তাতে তাঁর মদত ছিল। সত্যিই কি তাই? ভীমা কোরেগাঁও-এর সমাবেশইবা কেন? আর তার সঙ্গে স্ট্যান স্বামীর যোগসূত্রই বা কী?

ঝাড়খন্ড থেকে ভীমা কোরেগাঁও ১৮০০ কিমি দূরে। ২০০ বছর আগে ১৮১৮ সালে এ অঞ্চলে ব্রাহ্মণ পেশোয়া বাজিরাও রাজত্বে বাস করত নিঃস্ব জমিহীন অস্পৃশ্য মাহার সম্প্রদায়। তাঁদের প্রতি উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের বিধান ছিল যে মাহারদের গলায় ঝুলাতে হবে পিকদান, যাতে থুতু না পড়ে মাটিতে, আর পিছনে বেঁধে নিতে হবে ঝাঁটা, যাতে তাঁরা যাতায়াতে রাস্তা যতটুকু অপবিত্র হয় তা পরিষ্কার হয়ে যায় ঝাঁট দিয়ে। ঘটনাক্রমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে বাজিরাও-এর যুদ্ধে দরিদ্র মহারেরা বাজিরাও-কে সাহায্য করতে চাইলে ব্রাহ্মণ অভিজাত্যের কারণে প্রত্যাখ্যান করে। ইংরেজরা সুযোগ বুঝে এদের অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করে, যুদ্ধ নেয়। ঐ যুদ্ধে বাজিরাও পরাজিত হয়, সেখানে বিজয় স্তম্ভ তৈরি হয়, বিজয় স্তম্ভে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্যদের সঙ্গে ২২জন মাহারের নাম খোদিত হয়। ১৯২৭ সালের ১লা জানুয়ারী আম্বেদকর ঐ স্থানে যান। তারপর থেকে ব্রাহ্মণদের শত শত বছরের অত্যাচারের প্রতিবাদ স্বরূপ ১লা জানুয়ারী দলিতদের জমায়েত হয়ে আসছে। এতদিন এর কোন প্রচার ছিল না। কিন্তু এতে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণদের এবং বিজেপি'র সুনজর ছিল না। ২০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১৮ সালের ১লা জানুয়ারী কয়েক লক্ষ দলিত মানুষ জমায়েত হয়েছিল। সংবাদে প্রকাশ, গেরুয়া পতাকা নিয়ে সেখানে কয়েকজন ঢোকার চেষ্টাতে সংঘর্ষ বাঁধে। শুরু হয় পাথর ছোড়া ছুড়ি, তাতে বহু লোক আহত হন। একজন সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়। ৩রা জানুয়ারী মৃত্যু ও জামায়াতের উপর আক্রমণের প্রতিবাদে কিছু দলিত সংগঠন বনধ ডাকে ও মহারাষ্ট্র অচল হয়, সংবাদপত্রে প্রচার হয়। ২০০ বছরের আগের কলঙ্কজনক ইতিহাস মানুষ জানতে পারে, দলিতদের কাছে এটা হল বিজয়, আর উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কাছে চরম অপমান ও আতঙ্কের। সে যাই হোক, বনধে বিজেপি শুধু দলিতদের জেলে পোড়ে। বিজেপি এই সুযোগে যে সমস্ত মানুষ দলিতদের পাশে থেকে কাজ করেছিলেন বা কথা বলছিলেন তাদের ফাঁসানো চক্রান্ত করে। এ জামায়াতকে বেআইনি ঘোষণা করে স্ট্যান স্বামী সহ ১৮ জনকে গ্রেফতার করে। ফলে এই ঘটনার সঙ্গে স্ট্যান স্বামীর কোন যোগও ছিল না, সম্ভবত তিনি জানতেনও না।

স্ট্যান স্বামীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল ইউ এ পি এ আইনে। সেই আইনই বা কী? কিভাবে ও কেন এই আইন গণতন্ত্রকে হত্যা করে?

১৯৬৭ সালে কংগ্রেস সরকার এই আইন চালু করে। ২০০৪ সালে সংশোধনী এনে কঠোর করা হয়। ২০০৮ এবং ২০১২ সালে আরো দুটি সংশোধনী আনা হয়। ২০১৯ সালে আবার সংশোধনী আনা হয়। বর্তমান অবস্থা হল, এই আইনে চার্জশিট ছাড়াই গ্রেফতার, জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা শর্ত আরোপ, সন্ত্রাসবাদি কার্যকলাপের সংজ্ঞার আওতাবৃদ্ধি, সংগঠন শুধু নয় যে কোন ব্যক্তিকে সন্ত্রাসবাদি, রাষ্ট্রবিরোধী দেগে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। এই আইন মেনেই বিনা প্রমাণে যে কোন ব্যক্তিকে দিনের পর দিন কারাগারে ফেলে রাখা সম্ভব, নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা সম্ভব।

ভারতে বর্তমান হল বিনা বিচারে পুলিশ যে কোনো ব্যক্তিকে বছরের পর বছর আটকে রাখছে। দলিত আদিবাসী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, রাজনৈতিক কর্মী প্রভৃতি মানুষের ওপর এই দুর্ভোগ অহরহ হচ্ছে। আটক অবস্থায় অমানবিক অত্যাচারের শিকার হচ্ছে, এমন কি সুস্থ-সবলদের মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে। আর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা বললে তো কথাই নেই। সন্ত্রাসবাদের জুজুতে দেশবাসীরও একটা সমর্থন থাকে। ফলে পুলিশি দমন-পীড়ন বৈধ হয় এবং বৃদ্ধি পায়। এতে গণতান্ত্রিক অধিকার সংকটাপন্ন হচ্ছে। এই আইন কংগ্রেস, বিজেপি, তৃণমূল এমনকি বামপন্থী সি পি আই (এম)-রা ক্ষমতায় থেকে সরকারবিরোধী মানুষের ওপর প্রয়োগ করেছে, রাজনৈতিক কর্মী ও সমাজকর্মীদের আটক করেছে, বিনা বিচারে দীর্ঘদিন জেলে রেখেছে। আর মানুষের নিরপেক্ষ ও নিষ্ক্রিয় থাকার কারণে ভয়ঙ্কর দমন-পীড়ন করতে পারছে। তাই শাসক দল গুলো এই আইন প্রত্যাহার করার কোন প্রচেষ্টা দেখা যায় নি। আজও এই ধারা অব্যাহত। ফলে ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আজ চরম প্রশ্নের মুখে। যে কারণে স্ট্যান স্বামীর গ্রেফতার অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের এক ঘৃণ্য নজির।

যে কোন মানুষের চোখে দেখার, ঠিকমতো খাওয়ার, সুস্থভাবে চলাচল করার অধিকার থাকার কথা। চশমা দেওয়া হবে না, খাবার ব্যবস্থা করা হবে না, ৮৪ বছরের অশক্ত বৃদ্ধকে লোহার বেড়ি পায়ে নিয়ে হাঁটতে হবে - এতো চরম অত্যাচার শুধু নয়, হত্যা করার এক প্রচেষ্টা। তাই 'প্রতিষ্ঠানিক হত্যা' বা হত্যা করার 'ষড়যন্ত্র' যাঁরা বলছেন তা একেবারে অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

কিন্তু কেন এই প্রচেষ্টা?

সাধারণতঃ আমরা দেখি, সরল সহজ মানুষ, যাঁরা অর্থনৈতিক শোষণে জেরবার, যাঁদের ঘরে খাবার নেই, যাঁদের ঘরে আজও শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়া হয় নি, যাঁরা আজও আধুনিক রীতিনীতিতে অভ্যস্ত নন তাঁরা প্রতি পদে পদে অপমানিত হন, লাঞ্ছিত হন। দেশের আইনে এঁদের ওপর যথেচ্ছ প্রয়োগ হয় নির্দ্বিধায়। বিনা বিচারে আটক করে রাখে, অকথ্য দুর্ব্যবহারের শিকার হন।

তবুও এই সরল মানুষগুলো চান শুধু নিজের চেষ্টায় বেঁচে থাকতে। জল, জঙ্গল, মাটি তাঁদের সম্বল। এটা রক্ষা করতে তাঁরা চান। মালিকি ব্যবস্থা তাঁরা বোঝেন না। মালিকদের স্বার্থে সরকারের দমন-পীড়ন তাঁদের কাছে আতঙ্কের। এঁদের সহজে উচ্ছেদ করা যায়, জল-জমি-জঙ্গলের অধিকার থেকে সহজে বঞ্চিত করা যায়। এঁদের এই অবস্থা দেখে যদি কোন সহৃদয় মানুষ, গণতান্ত্রিক ব্যক্তি বা সমাজকর্মী পাশে এসে দাঁড়ান তবে সরকার তাঁকে রাষ্ট্রবিরোধী, সন্ত্রাসবাদী তো বলবেই, কারণ রাষ্ট্রের কর্ণধার রাতো ধনিক শ্রেণীর সেবাদাস; পার্লামেন্ট, সরকার সবই তো তাঁদের স্বার্থেই। সেই কারণেই দলিত সমাবেশকে 'সরকার ফেলে দেওয়ার চক্রান্ত, প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্র' অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে ভীম কোঁরেগাও-এর ঘটনার সঙ্গে মিথ্যা যোগসাজগের অভিযুক্তদের স্ট্যান স্বামীসহ একদল প্রতিবাদী মানুষের কন্ঠকে রোধ করতে আটক করা হয়েছে। আদিবাসীদের জল-জমি-জঙ্গল থেকে অবাধে উচ্ছেদ করে প্রতিবাদহীন সমাজ গড়ে যাতে ভারতবর্ষকে ধনীক শ্রেণীর অবাধ লুণ্ঠনের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করা যায় -এটাই হল মূল কারণ। আর এই কাজই নির্লজ্জভাবে করেছে অতীতের সব সরকারের মতো বর্তমান কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার। স্ট্যান স্বামীর গ্রেফতার ও হত্যা এই কারণেই।

Post a Comment

0 Comments